জোবায়ের আহমেদ নবীন
দেশজুড়ে আলোচিত এক ইস্যুর নিচে চাপা পড়ছে আরেকটি ইস্যু। এক ঘটনার মধ্যে চাপা পড়ছে আরেক ঘটনা। অথচ কোনো ঘটনারই ঠিকমতো কুলকিনারা হচ্ছে না। সাময়িকভাবে কয়েকদিন আলোচনায় থাকলেও পরের ইস্যু সামনে চলে আসলে আগের ইস্যু নিয়ে আর থাকছে না কারো মাথাব্যথা। বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে, বেশ কয়েকদিন গণমাধ্যমগুলো ওই বিষয়ে সরগরম থাকে। কিন্তু নতুন কোনো ইস্যু সামনে চলে আসলে অনেকটা আড়ালে চলে যায় সেই আলোচিত ইস্যু। এর পর দেশবাসীও নতুন ইস্যু নিয়ে আলোচনার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেন।
এ ছাড়া কোনো একটি ঘটনার পর সেটি কেন ঘটল, দায়ী কে— সে ব্যাপারে সঠিক তদন্ত না হওয়া ও দোষীদের শাস্তি না হওয়ায় নিয়মিত ঘটছে এমন ঘটনা। একটি ঘটনার কূলকিনারা হওয়ার আগেই আরেকটি ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্পর্শকাতর উল্লেখ করলেও রহস্যজনক কারণে এগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় না। এক সময় এ গুলো ফাইলবন্দি হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরারে চলে যায়। বছরের পর বছর চলে বিচার প্রক্রিয়া। এমনই বিভিন্ন ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম আলোচিত ইস্যু হচ্ছে বরগুনার রিফাত হত্যা। এর আগে আলোচনায় ছিল মামলার তদন্তে সাংবাদিকদের তলব করে দুদকের চিঠি অতঃপর আন্দোলন। তারআগে রূপপুর পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশ কাণ্ড! এর আগে ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা। একইসঙ্গে গ্রিনলাইন পরিবহনের একটি বাস চাপায় পা হারানো রাসেলও আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু এর আগে দেশজুড়ে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুন। নুসরাত জাহান রাফির ইস্যু সামনে চলে আসায় অনেকটা ফিকে হয়ে যায় বনানীর আগুনের ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন। তার আগে আলোচনায় ছিল পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। বনানীর আগুনের ইস্যু সামনে আসায় ফিকে হয়ে যায় পুরান ঢাকার সেই আগুনের ক্ষতচিহ্নের স্মৃতি। এভাবেই এক ইস্যুর আড়ালে নিরবে চলে যায় আরেক ইস্যু।
রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের দেশটা মূলত একটা ইস্যুর দেশ। একটা ইস্যুর জের কাটতে না কাটতেই চলে আসে আরেকটা ইস্যু। সরকারি অফিসে ফাইলের নিচে ফাইল চাপা পড়ে যাওয়ার মতো এখানে ইস্যুর নিচে ইস্যু চাপা পড়ে যায়। এর ফলে একটা নতুন ইস্যু আগের সব ইস্যু থেকে নাগরিকদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়।
এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা জানান, রাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশে সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই তার ওপর হামলা হয়েছিল। ওই ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছনার ঘটনায় সকলের মনোযোগ তনু হত্যাকাণ্ড থেকে সড়ে যায়। এরপর যখন পুলিশ সুপার (সাবেক) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু খুন হলেন তখন আগের ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যায়। এরপর গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় চাপা পড়ে যায় মিতু ও বাবুল আক্তার। সে সময় জঙ্গি ইস্যুতে চাপা পড়ে রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্পে সুন্দরবন ইস্যু। এ ছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমসহ বিভিন্ন ইস্যু চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
এ ব্যাপারে কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘এটি আসলে আমাদের দেশে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এক ধরণের দায়-মুক্তিও বলা যায়। কারণ সংশ্লিষ্টরা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতো তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। কিন্তু তারা সেটা করছে না। যেমন- নিমতলি ট্যাজেডির পর আমরা আন্দোলন করেছি। সে সময় যদি সিটি কর্পোরেশন সঠিক পদক্ষেপ নিতো তাহলে আর চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির জন্ম হতো না।’
তিনি বলেন, ‘একটা ইস্যুর পর যখন নতুন কোনো ইস্যু সামনে চলে আসে তখন আগের ইস্যু নিয়ে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্টরা তেমন করে চাপ অনুভব করে না। এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের দায়সারা ভাব দেখা দেয় যা, সার্বিক দিক বিবেচনায় ক্ষতিকর। এছাড়া কোনো ঘটনার তদন্ত করে এর পরিপূর্ণ মিমাংসা করার মনোবৃত্তিও তাদের মধ্যে দেখা যায় না।’ এ ক্ষেত্রে যার যার অবস্থান থেকে প্রত্যেককে আরো সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।